করোনা প্রতিরোধ ও মহামারি থেকে রক্ষায় প্রস্তাবনা

ডা. মো. হাসান ইমাম

২৩

করোনা ভাইরাস প্রতিরোধ ও চিকিৎসার জন্য ইতিমধ্যে সরকার বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়েছে এবং মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দিন রাত কাজ করে যাচ্ছেন। যার ফলে এখনো বাংলাদেশকে সংক্রমণের ৪র্থ ধাপের মারাত্মক ঝুঁকি থেকে বের করে আনার একটা শেষ সুযোগ আছে। কিন্তু বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও দপ্তরের সমন্বয়হীনতা এবং জনগণের অসচেতনতার জন্য সব উদ্যোগ ব্যর্থ হতে চলেছে। দেশ আজ মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে পড়ে গেছে। সংক্রমণের ৪র্থ ধাপের মারাত্মক ঝুঁকি থেকে বাঁচতে হলে নিম্নের প্রস্তাবনাগুলো আগামী সাত থেকে দশ দিনের মধ্যে বাস্তবায়ন করা অত্যন্ত জরুরি। যদি করা যায়, তাহলে বাংলাদেশকে কিছু দিনের মধ্যে করোনা ভাইরাসের মহামারির হাত থেকে মুক্ত করা যাবে বলে আশা করি।

১. মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে জাতীয় দুর্যোগ সংক্রান্ত কাউন্সিল জরুরি ভিত্তিতে গঠন। (যৌক্তিকতা: স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে অন্য মন্ত্রণালয়গুলো সমন্বয় করছে না।)

- Advertisement -

২. ঢাকার যে সকল এলাকা এবং দেশের যে সকল বিভাগ, জেলা ও উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়েছে, তাদের পরিবার এবং আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শে আসা সকল ব্যক্তি এবং সংক্রমিত সকল এলাকার ওয়ার্ড/গ্রাম/মহল্লা ভিত্তিক সন্দেহজনক সকল পরিবারকে আগামী সাত থেকে দশ দিনের মধ্যে সর্বোচ্চ জনবল নিয়োগ করে করোনা টেস্ট (প্রতিদিন ন্যূনতম দশ হাজার) করতে হবে। যাদের টেস্ট পজিটিভ হবে তাদেরকে দ্রুত প্রাতিষ্ঠানিক আইসোলেশনে এবং সংস্পর্শে আসা ব্যক্তিদের প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিনে নিতে হবে। (যৌক্তিকতা: জনগণ নিজ বাড়িতে আইসোলেশন/ কোয়ারেন্টিন মেনে চলতে পারে না, বরং প্রতিবেশী ও পরিবারের অন্যদের আক্রান্ত করে ফেলে। প্রথম ধাপে শুধু সংক্রমিত জেলা/ এলাকাগুলোর বিশেষ করে হটস্পটগুলি করোনা টেষ্টের আওতায় আনতে হবে, সে জন্য সংক্রমিত ৬০টি জেলার মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, সদর হাসপাতালে করোনা টেষ্টের সেন্টার করতে হবে অথবা বর্তমানে প্রতিষ্ঠিত সেন্টারগুলির টেষ্টের সক্ষমতা বাড়িয়ে পরীক্ষা করা এবং মেডিকেল কলেজ, সদর ও উপজেলা হাসপাতালের টেকনোলজিষ্ট ও কমিউনিটি ক্লিনিকে কর্মরত সিএইচপিদের মাধ্যমে সংক্রমিত এলাকার ঘরে ঘরে গিয়ে দ্রুত স্যাম্পল সংগ্রহ করতে হবে।)

৩. বাংলাদেশের প্রতিটি বিভাগ, জেলা, উপজেলা, ইউনিয়ন ও গ্রামে যাদের ন্যূনতম করোনার উপসর্গ আছে এবং করোনার উপসর্গ নিয়ে মৃত্যু বরণ করেছে, সর্বচ্চ জনবল নিয়োগ করে তাদের সকলের আগামী সাত থেকে দশ দিনের মধ্যে করোনা টেষ্ট করতে হবে এবং রিপোর্ট না পাওয়া পর্যন্ত তাদের সবাইকে প্রাতিষ্ঠানিক আইসোলেশন/ কোয়ারেন্টাইনে রাখতে হবে। দক্ষিণ কোরিয়ার মত পিপিই ছাড়া করোনা টেষ্ট বুথ বানিয়ে স্যাম্পল সংগ্রহ করা যায় অথবা মেডিকেল কলেজ, জেলা, উপজেলা, ইউনিয়ন হাসপাতালের টেকনোলজিষ্ট ও কমিউনিটি ক্লিনিকে কর্মরত সিএইচপিদের মাধ্যমে স্যাম্পল সংগ্রহ করতে হবে, এতে সমগ্র দেশের যে কোন স্থানে দ্রুত সময়ে স্যাম্পল সংগ্রহ করা যাবে। যাদের স্যাম্পল সংগ্রহের অভিজ্ঞতা নেই তাদেরকে দ্রুত অনলাইন/ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে প্রশিক্ষণ প্রদান করতে হবে।

৪. করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত এলাকা এবং জেলাগুলিতে সরকারের পক্ষ থেকে লকডাউন করা হলেও জনগণের অসচেতনতার জন্য অনেকেই লকডাউন সঠিকভাবে মানছে না। লকডাউন শতভাগ কার্যকরী করতে হলে এখনই কারফিউ অথবা জরুরি আইন প্রয়োগের মাধ্যমে ঘরে থাকা বাধ্যতামূলক করতে হবে। একটু কষ্ট করে সবাইকে ৭ থেকে ১০ দিন ঘরে রাখতে পারলে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ করা যাবে। যে সকল জেলা সংক্রমিত হয় নাই সেসকল জেলায় বাহির থেকে কাউকে প্রবেশ করতে না দেওয়া এবং কাউকে অন্য জেলায় যেতে না দেওয়া।

বিশেষজ্ঞদের নিয়ে দুইটি টিম গঠন করে একটি টিমকে শুধু প্রতিরোধকমূলক কাজে সকল প্রকার ব্যবস্থা গ্রহণ এবং অন্য টিমকে চিকিৎসা ব্যবস্থাপনার কাজে হাসপাতালগুলোতে দক্ষ জনবলসহ প্রয়োজনীয় সরঞ্জামের নিশ্চিত করণ, চিকিৎসা সংক্রান্ত সকল প্রকার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

৫. যাদের সক্ষমতা আছে শুধু তাদেরকে অর্থের বিনিময়ে এবং সকল গরীব ও নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য ঘরে ঘরে বিনামূল্যে সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিজিবি,পুলিশ, র‌্যাব, আনসার, জেলা প্রশাসক, ইউএনও এবং জন প্রতিনিধিদের মাধ্যমে খাবার পৌঁছে দিতে হবে। (যৌক্তিকতা: তাহলে খাবারের জন্য অথবা অন্য কোনো অজুহাতে ঘর থেকে কেউ বের হবে না এবং না খেয়ে কেউ কষ্ট পাবে না। ঘরে খাবার না থাকলে শত চেষ্টা করলেও মানুষ ক্ষুধার জ্বালায় ঘর থেকে বের হবে। চীন, দক্ষিণ কোরিয়া, তাইওয়ান, ভিয়েতনাম, ভারতের কেরেলা এই পদ্ধতি অবলম্বন করে সফল হয়েছে।)

৬. বাংলাদেশে প্রচুর সংখ্যক এক্সপ্রেস ট্রেন, স্টিমার, লঞ্চ, উন্নতমানের হোটেল, আশুলিয়ার ইজতেমা মাঠ, স্টেডিয়াম, সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালের বেড বর্তমানে অব্যবহিত আছে। ট্রেনের বগি, লঞ্চ স্টিমারের কেবিন, হোটেলের কেবিনগুলি, ইজতেমা মাঠ, ঢাকাসহ যেসকল জেলায় করোনা রোগী শনাক্ত হয়েছে সেসকল জেলার স্টেডিয়াম, সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে অস্থায়ী করোনা হাসপাতাল অথবা আইসোলেশন ও কোয়ারেন্টিন সেন্টার করার ব্যবস্থা গ্রহণ। (যৌক্তিকতা: এ ধরনের সেন্টারে করোনা আক্রান্ত ও সন্দেহভাজন রোগী রাখলে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ করা যাবে। বাসায় রেখে আইসোলেশন/কোয়ারেন্টাইন শতভাগ কার্যকর করা সম্ভব না, কারণ সকলের বাসায় পৃথক একাধিক টয়লেট ও পর্যাপ্ত রুম নাই।)

৭. দেশের সকল বিভাগ, জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে ফায়ার সার্ভিস, ওয়াসা, সিটি কর্পোরেশন, পৌরসভার পক্ষ থেকে প্রতিদিন রাস্তায় জীবাণুনাশক স্প্রে করতে হবে। বিশেষ করে যেসকল বিভাগ ও জেলা সংক্রমিত। সকল যানবাহন বাহির থেকে এসে বাসায়/অফিসে প্রবেশের পূর্বেই গেটের বাহিরে চাকাসহ যানবাহন জীবাণুনাশক দিয়ে স্প্রে করতে হবে এবং ঘরের বাহিরে যারা যাবেন সবাই বাসার মেইন গেটের বাহিরে জুতা/ স্যান্ডেল স্প্রে করে জুতা ঘরের বাহিরে রাখতে হবে। (যৌক্তিকতা: যানবাহনের চাকা ও জুতার মাধ্যমে করোনা ভাইরাস ফ্ল্যাট/বাসায় সংক্রমিত করে)

৮. ১ মার্চ ২০২০ তারিখ থেকে যতজন ব্যাক্তি বিদেশ থেকে বাংলাদেশে বিমান বন্দর, স্থল বন্দর, নৌ বন্দর, সমুদ্র বন্দর, রেলপথ দিয়ে প্রবেশ করেছে তাদের সকলের এবং তাদের পরিবারের করোনা টেস্ট করতে হবে। (যাদের টেস্ট করা হয়েছে এবং ১৪ দিন কোয়ারেন্টিন সম্পন্ন করে সুস্থ আছে তারা ব্যতীত) অথবা বিদেশ ফেরত সকলের ঘরে ঘরে গিয়ে নিয়মিত পর্যবেক্ষণে রাখতে হবে। যাদের করোনা টেস্ট পজিটিভ হবে তাদের সকলকে দ্রুত প্রাতিষ্ঠানিক আইসোলেশনে নিতে হবে এবং করোনা রোগীর সংস্পর্শে যারা ছিল তাদেরকে প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিনে নিতে হবে। (যৌক্তিকতা: শুধু শরীরের তাপমাত্রা মেপে করোনা ভাইরাস শনাক্ত করা যায় না। বিমানবন্দরসহ সকল বন্দরে বিদেশ থেকে আগত যাত্রীদের শরীরের তাপমাত্রার মাধ্যমে স্ক্রিনিং করা হয়েছিল। তাদের সকলের স্যাম্পল সংগ্রহ করা প্রয়োজন ছিলো)।

৯. করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তিদের সকল তথ্য ডাটাবেইজ তৈরি করে তাদের যাতায়াত মোবাইল ফোন ট্রেকিংয়ের মাধ্যমে কন্ট্রাক্ট ট্রেসিং বের করে সংস্পর্শে আসা ব্যক্তিদের দ্রুত টেষ্ট করে আইসোলেশন করা। এ বিষয়ে আইসিটি মন্ত্রণালয় উদ্যোগ নিতে পারে। (যৌক্তিকতা: দক্ষিণ কোরিয়া, তাইওয়ান কন্ট্রাক্ট ট্রেসিংয়ের মাধ্যমে আক্রান্তের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণে সফল হয়েছে)।

১০. মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক নির্দেশিত ৩১ দফা কঠোরভাবে পালনের ব্যবস্থা করণ।

১১. শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ভালো থাকলে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তি দ্রুত সুস্থ হয়ে ওঠে এবং আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কাও কম থাকে। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানো এবং করোনার ভাইরাসের প্রতিরোধক হিসাবে প্রতিটি মানুষকে আদা, দারুচিনি, লবঙ্গ, যষ্টিমধু, কালজিরা, হলুদ, ত্রিফলা ও তুলসীপাতা জ্বাল দিয়ে চায়ের মতো সেবন, প্রতি বেলায় কুসুম গরম পানি সেবন ও গার্গেল করা এবং ভিটামিন সি অথবা ভিটামিন সি যুক্ত ফল দিনে দুই বার খাবার উপদেশ প্রদান। (এ সকল উপাদান জেলা প্রশাসক, ইউএনও, সিটি কর্পোরেশন, পৌরসভা, ইউনিয়ন পরিষদের প্রতিনিধির মাধ্যমে সকল ঘরে পৌঁছে দেওয়া সম্ভব)।

সারসংক্ষেপ: আগামী দশ দিনের মধ্যে আক্রান্ত ব্যক্তিদের দ্রুত শনাক্ত করা (প্রতিদিন ন্যূনতম দশ হাজার টেস্ট করা, ২৫ এপ্রিল পর্যন্ত ৫ হাজার আক্রান্ত ব্যক্তি, তাদের পরিবার ও আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শে আসা সকল ব্যক্তির টেষ্ট করে দ্রুত পজিটিভ ব্যক্তিদের প্রাতিষ্ঠানিক আইসোলেশন/প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিনের মাধ্যমে পৃথক করা , বিদেশ ফেরত ব্যক্তি ও পরিবারের দ্রুত পরীক্ষা করা, মোবাইল ট্রেকিংয়ের মাধ্যমে কন্ট্রাক্ট ট্রেসিং করা, বাসা থেকে জরুরি প্রয়োজন ছাড়া কাউকে বের হতে না দেওয়া, কঠোরভাবে লকডাউন শতভাগ কার্যকর করা, সক্ষম ব্যক্তিদের অর্থের বিনিময়ে ও অক্ষমদের বিনামূল্যে সকলের ঘরে খাবার পৌঁছে দেওয়া।

লেখক: চিকিৎসক, এসপি হাসপাতাল, আদাবর, ঢাকা।

এই বিভাগের আরও সংবাদ