করোনাভাইরাসের প্রভাবে চরম আর্থিক সঙ্কটে পড়েছে দেশের প্রায় ২৪ হাজার সমবায়ী প্রতিষ্ঠান। দীর্ঘ ছুটির কবলে এসব প্রতিষ্ঠানের নিয়মিত ঋণ আদায় ও সঞ্চয় কার্যক্রম প্রায় বন্ধ হওয়ার উপক্রম। আদায় ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে মাঠ পর্যায়ে ঋণ বিতরণ করা সাধারণের সঞ্চয়ের প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকার। বেকার হয়ে পড়ার আশঙ্কা করছে সমবায়ী প্রতিষ্ঠানগুলোর সাথে সরাসরি জড়িত ৯ লক্ষাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারী। অস্তিত্ব রক্ষার্থে এনজিও ঋণের মতো সমবায়ী প্রতিষ্ঠানগুলোকে প্রণোদনার অর্থ বরাদ্দের দাবি জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
সাবেক সচিব ও সমবায় অধিদফতরের সাবেক নিবন্ধক মো: হুমায়ুন খালিদ গতকাল নয়া দিগন্তকে জানিয়েছেন, করোনাভাইরাসে বিশ্বের মতো আমরাও মহাসঙ্কটে পড়তে যাচ্ছি। বর্তমানে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানগুলোতে আর্থিক সঙ্কট শুরু হয়েছে। সামনে খাদ্য সঙ্কটের মুখে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। এ পরিস্থিতি থেকে উত্তোরণের জন্য দেশের প্রায় লক্ষাধিক সমবায়ী প্রতিষ্ঠানগুলোকে সচল রাখতে হবে। মিল্কভিটার মতো বিভিন্ন সমবায়ী প্রতিষ্ঠান যারা সরাসরি আয় উৎসারি কাজের সাথে জড়িত এমন প্রতিষ্ঠানগুলোকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চালু রাখতে হবে। আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর সদস্যরা যাতে এসব কাজে বাধা না দেয় সে দিকে খেয়াল রাখতে হবে। একই সাথে এনজিওদের মতো সরাসরি ঋণকার্যক্রমের সাথে জড়িত প্রায় ২৪ হাজার সমবায় প্রতিষ্ঠানগুলোকে প্রণোদনার ব্যবস্থা করতে হবে। কারণ, চলমান পরিস্থিতিতে যারা ঋণ নিয়েছেন, আয় বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তারা সেটা পরিশোধ করতে পারছেন না। তাদেরকে আয় উৎসারি কাজে অংশগ্রহণ করতে অর্থের জোগান দিতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংক যেমন এনজিওদের সদস্যদের মধ্যে ঋণ দেয়ার জন্য ৩ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনার তহবিল করেছে তেমনি সমবায়ী প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য প্রণোদনার উদ্যোগ নিতে হবে। নইলে এসব প্রতিষ্ঠানে যারা সঞ্চয় রেখেছিলেন তারা অর্থ ফেরত পাবেন না। তিনি মনে করেন, এ জন্য সমবায় মন্ত্রণালয়সহ সমবায় অধিদফতরকে এগিয়ে আসতে হবে। সাধারণ ছুটির মধ্যে সরকারি কর্মকর্তারা ঘরে বসে থাকলে, আর অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড থেমে গেলে একসময় তাদেরও বেতন-ভাতা বন্ধ হয়ে যাবে।
সমবায় অধিদফতর থেকে নিবন্ধিত সমবায়গুলো তাদের সমিতির সদস্যদের কাছ থেকে সঞ্চয় ও আমানত নিয়ে আবার সমিতির সদস্যদের মধ্যেই গাভী পালন, মিল্কভিটার মতো বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজে ঋণ প্রদান করে থাকে। ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, উদ্যোক্তা, হকার, ছোট দোকানদার, বস্তিবাসীর মাধ্যমে এর কার্যক্রম পরিচালিত হয়। সঞ্চয় গ্রহণ ও ঋণ কার্যক্রম, ব্যাংকে এফডিআর সব মিলে বছর শেষে যে পরিমাণ মুনাফা হয় তা সমিতির সদস্যদের মধ্যে আনুপাতিক হারে বিতরণ করা হয়। কিন্তু দেশব্যাপী সাধারণ ছুটি ও লকডাউনের কারণে প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যক্রম বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে।
করোনাভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিরোধে দীর্ঘ এক মাস যাবত সরকারি নির্দেশে প্রায় সব ধরনের অফিস বন্ধ রয়েছে। অধিকাংশ জেলা লকডাউন করা হয়েছে। এতে সমবায় প্রতিষ্ঠানগুলোর নিয়মিত ঋণকার্যক্রমসহ সব আর্থিক কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। এতে সুযোগসন্ধানী কিছু সদস্য ঋণের কিস্তি, শেয়ার ও সঞ্চয় প্রদান বন্ধ করার সুযোগ চাচ্ছে। এতে প্রতিষ্ঠানগুলো আর্থিক সঙ্কটের মুখে পড়েছে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশে ক্রেডিট ইউনিয়নগুলোর শীর্ষ প্রতিষ্ঠান কাল্ব’র সাবেক সেক্রেটারি নির্মল রোজারিও গতকাল নয়া দিগন্তকে জানিয়েছেন, বেশির ভাগ এলাকায় লকডাউন ও সাধারণ ছুটির মধ্যে প্রতিষ্ঠানগুলো কোনো কাজ করতে পারছে না। এতে সমবায়ী প্রতিষ্ঠানগুলোর সাথে যারা জড়িত আছেন তারা বেকার হয়ে পড়েছেন। তারা সমবায় থেকে যে ঋণ নিয়েছিলেন তা পরিশোধ করতে পারছেন না। অপর দিকে সঞ্চয় ভাঙানোর একটি চাপ রয়েছে। এ পরিস্থিতিতে প্রতিষ্ঠানগুলোকে সচল রাখতে প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজের আওতায় আনতে হবে। এনজিওদের মতো তাদেরও ঋণের ব্যবস্থা করলে প্রতিষ্ঠানগুলো সচল থাকবে। সদস্যরা ঋণের অর্থ ফেরত দিতে পারবেন।
ক্রেডিট ইউনিয়ন সম্প্রীতির প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী এমদাদ হোসেন মালেক জানিয়েছেন, নিজস্ব অর্থায়নে পরিচালিত হয় সমবায় প্রতিষ্ঠানগুলো। করোনাভাইরাসের কারণে সদস্যরা ঋণের অর্থ ফেরত দিতে পারছেন না। আবার যারা সঞ্চয় রেখেছিলেন তাদেরও সঞ্চয় ভাঙানোর একটি চাপ রয়েছে। সব মিলে প্রতিষ্ঠানগুলো আজ এক কঠিন পরিস্থিতির মুখে এসে দাঁড়িয়েছে। এ পরিস্থিতি থেকে উত্তোরণের জন্য সমবায় অধিদফতরসহ সরকারের সংশ্লিষ্টদের এগিয়ে আসতে হবে। তাদের কার্যক্রম পরিচালনার জন্য সমবায় অধিদফতর থেকে সুনির্দিষ্ট একটি সার্কুলার জারি করা একান্ত প্রয়োজন বলে মনে করেন। বর্তমান সঙ্কটকালে সমবায় উন্নয়ন তহবিল থেকে বিনা সুদে তাদের ঋণ দেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। একই সাথে সব সমবায় সমিতির অর্জিত নিট মুনাফার ওপর ২০১৫ সাল থেকে আরোপিত ১৫ শতাংশ কর প্রত্যাহারের ব্যবস্থা করতে হবে।
প্রসঙ্গত, সমবায় অধিদফতরের সবশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দেশে সরাসরি ঋণ কার্যক্রমের সাথে জড়িত সমবায় সমিতির সংখ্যা প্রায় ২৪ হাজার। এর সদস্য সংখ্যা প্রায় ১ কোটি ১০ লাখ। সমিতিগুলোর সঞ্চয় আমানত রয়েছে প্রায় ৭ হাজার ১৮২ কোটি টাকা। ঋণ বিতরণ করা হয়েছে ৬ হাজার ৪৭ কোটি টাকা এবং আদায় হয়েছে ৪ হাজার ৮৬৮ কোটি টাকা। আর সংরক্ষিত তহবিল রয়েছে প্রায় ৯৩০ কোটি টাকা। সমিতিগুলোর কার্যক্রম পরিচালনার জন্য এদের অফিসে সরাসরি চাকরি করেন ৯ লক্ষাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারী।